পারসিক সাম্রাজ্য

ইরানের প্রাচীনতম ধর্ম মাযদাইয়্যাত ধর্মের স্থান দখল করল যরদশ্ত ধর্ম। এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যরদশ্ত খ্রিস্ট পূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে আবির্ভূত হন। পারসিক সাম্রাজ্য প্রাচ্যের রোমান সাম্রাজ্যের তুলনায় (মহান রোম সাম্রাজ্য থেকে পৃথক হওয়ার পর) আপন আয়তন, আয়-আমদানির উপায়-উপকরণ ও শান শওকতের ক্ষেত্রে অনেক বড় ছিল। এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল সম্রাট আর্দেশীরের হাতে ২২৪ খ্রিস্টাব্দে। আপন উত্থানকালে আসিরিয়া, খুযিস্তান, মিডিয়া, পারস্য, আযারবায়জান, তাবারিস্তান, সারখস, মারজান, কিরমান, মার্ভ বলখ, সুগাদ, সীস্তান, হেরাত, খুরাসান, খাওয়ারিযম, ইরাক ও ইয়ামন-সবটাই তার শাসনাধীনে ছিল। কোন এক যুগে সিন্ধু নদের অববাহিকার মধ্যবর্তী জেলাসমূহ ও তার গতিপথের আশপাশের প্রদেশগুলো অর্থাৎ কচ্ছ, তেসিফোন (আল-মাদায়েন) ছিল এই সাম্রাজ্যের রাজধানী এবং তা ছিল শহরসমূহের এক সমষ্টি যা তার আরবী নাম থেকেই অনুমান করা যায়। পঞ্চম শতাব্দী ও এর পরবর্তীকালে মাদায়েন আপন কৃষ্টি, উন্নতি, প্রগতি, বিলাস ও প্রাচুর্যের শীর্ষদেশে পৌঁছেছিল (বিস্তারিত জানতেচাইলে দেখুন অধ্যাপক আর্থার ক্রীস্টিনসেনকৃত ‘সাসানী আমলে ইরান’ নামক পুস্তক)।যরথুস্ত্র ধর্ম প্রথম দিন থেকেই আলো ও অন্ধকার, ভাল ও মন্দের দ্বন্দ্ব এবং ভালো খোদা ও মন্দের খোদার মধ্যকার সংঘাত-সংঘর্ষের মতবাদের ওপর কায়েম ছিল। খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দীতে “মানি” নামক একজন দার্শনিক এই ধর্মের সংস্কারক হিসাবে আবির্ভূত হন।৩০ এরপর সম্রাট শাহপূর [সাসানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট আদের্শীয় (মৃ. ১৪১ খ্রি.) এর পরবর্তী শাসক] প্রথমে এই ধর্মের অনুসারী ও আহ্বায়ক, এরপর এর বিরোধী হয়ে যান। বিরোধী হওয়ার কারণ, মানী দুনিয়া থেকে যাবতীয় মন্দ ও অন্যায়-অরাজকতার বীজ নির্মূল করবার জন্য নিঃসঙ্গ ও একক জীবন যাপনের আহ্বান জানাতেন। তার আহ্বান ছিল, আলো ও অন্ধকারের মিশ্রণ স্বয়ং নিজেই এমন এক অন্যায় ও মন্দ যার হাত থেকে মুক্তি লাভ করা মানুষের জন্য জরুরি। তিনি আত্মবিলুপ্তি ও নাস্তির মধ্যে বিলীন হওয়ার জন্য ও অন্ধকারের ওপর আলোর প্রাধান্য লাভের জন্য মানব বংশের ধারা খতম করা এবং দাম্পত্য সম্পর্ক নিঃশেষ করার পন্থা অবলম্বন করেন। কয়েক বছর তিনি নির্বাসনে কাটান। এরপর ইরানে ফিরে আসেন এবং প্রথম বাহরামের শাসনামলে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার প্রদত্ত শিক্ষামালা তার মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে এবং ইরানী চিন্তা-পদ্ধতি ও ইরানী সমাজকে বহুকাল ধরে প্রভাবিত করতে থাকে।

ঈসায়ী ৫ম শতাব্দীর সূচনায় মাযদাক আবির্ভূত হন। তিনি বিত্ত-সম্পদ ও নারীর ক্ষেত্রে পূর্ণ সাম্য ও সম-শরিকানার প্রকাশ্য ও খোলাখুলি আহ্বান জানান এবং এসব বস্তুর অগাধ ভোগ-ব্যবহার সমগ্র মানব সমাজের জন্য কোনরূপ বাধা- বন্ধন ছাড়াই বৈধ ঘোষণা করেন। তার এই আহ্বান খুব দ্রুত জোরদার হয়ে ওঠে। অবস্থা এই দাঁড়াল, মানুষ যে ঘরে যার ঘরে যখন ইচ্ছা অবাধে ঢুকে পড়ত এবং তার মাল-আসবাব ও মহিলাদের জোর করে দখল করে নিত। একটি প্রাচীন ইরানী দস্তাবিযে যা ‘নামায়ে তানাস্যুর’ নামে পরিচিত- এই অবস্থার চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে যা মাযদাকী মতবাদের উত্থান, একচ্ছত্র শাসন ও ক্ষমতার যুগে দেখা যায় :

“লোকলজ্জা ও সম্ভ্রমবোধ উঠে গেল। এমন সব লোকের জন্ম হলো যাদের ভেতর না ছিল ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ, আর না ছিল মৌরসি জমি-জিরাত। তাদের ভেতর বংশ, পরিবার কিংবা জাতিগোষ্ঠীর প্রতি মমত্বাবোধও ছিল না। তাদের ভেতর শিল্প ও কৃষিও ছিল না, ছিল না কোনরূপ চিন্তা-ভাবনার লেশ। তাদের কোন পেশা ছিল না। তারা যত রকমের চোগলখুরি ও শয়তানীতে সিদ্ধহস্ত, গালিগালাজ ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারে পটু এবং অপরের দোষারূপ করতে উস্তাদ ছিল। এটাই ছিল তাদের জীবন-জীবিকা আর এসব মাধ্যম বা পুঁজি করেই তারা পদ ও সম্পদ লাভে চেষ্টা করত।”৩১

আর্থার ক্রিস্টিনসেন তার ‘সাসানী আমলে ইরান’ নামক গ্রন্থে বলেন, ফল এই দাঁড়াল, চারদিকে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল। লুটতরাজকারীরা আমীর-উমারার বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ত এবং মালমাত্তা লুট করে নিয়ে যেত। মেয়েদেরকে জোর করে ছিনিয়ে নিত এবং জিম-জায়গা দখল করে নিত। এভাবে ক্রমান্বয়ে জমি-জিরাত পতিত ও অনাবাদী থাকতে শুরু করল। কেননা নতুন যারা জমির মালিক হলো তারা কৃষি সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিফহাল ছিল না। এসব থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়, প্রাচীন ইরানে চরমপন্থী আহ্বান আন্দোলনে সাড়া দেবার বিস্ময়কর যোগ্যতা ছিল। তারা সব সময় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে এবং চরম পন্থা গ্রহণে আগ্রহী ছিল। একদিকে তারা ‘খাও, দাও ও ফুর্তি কর’-এর মত চরম ভোগবাদ, অপরদিকে সর্বোচ্চ ধরনের বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসবাদের মাঝে ঘড়ির পেন্ডুলামের মত আন্দোলিত হতে থাকে। কখনও বা তারা খান্দানী ও মৌরসী সামন্তবাদী ব্যবস্থা, আবার কখনও-বা ধর্মীয় ইজারাদারির চাপের মুখে অবস্থান নেয়, কখনো নেয় তারা বল্গাহীন সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ ও অবাধ স্বেচ্ছাচারিতা, বেআইনি কার্যক্রম ও অরাজকতার মত পরিবেশের ছত্রছায়া। এজন্য তাদের মধ্যে কখনোই ভারসাম্য ও শান্তি সমঝোতাবোধ জন্ম নিতে পারেনি যা স্বাভাবিক ও সুস্থ সমাজের জন্য আবশ্যক। এই আমলে (বিশেষ করে সাসানী শাসনামলে ষষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত) অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গোটা দেশ ঐ সব রাজা-বাদশাহর দয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল যারা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজমুকুট ও শাহী তখতের মালিক হতো এবং নিজেদের সাধারণ গণমানুষের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ভাবত। সম্রাটকে আসমানী খোদার বংশধর বলে মান্য করা হতো (নাউযুবিল্লাহ)। শেষ পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় পারভেয নিজের নামের সঙ্গে নিম্নোক্ত উপাধিসমূহ ব্যবহার করতেন:

“ঈশ্বরমণ্ডলীর মধ্যে অবিনশ্বর, মানব ও মানবমণ্ডলীর মাঝে অদ্বিতীয় ঈশ্বর, তার নামের বিকাশ, সূর্যের সঙ্গে উদিতকারী, রাত্রির চক্ষুর সূর্যালোক।”৩২

দেশের সমস্ত সম্পদ ও আয়-আমদানির উপায়-উপকরণ বা মাধ্যমসমূহকে এসব রাজা-বাদশাহর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মনে করা হতো। সম্পদ মজুদকরণ, উপহার-উপঢৌকন ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী জড় করার পাগলামি, জীবন মানের সমুন্নতি, নিত্য নতুন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ ও মোহ, জীবনকে ভোগ করা, খেলাধুলা ও ভোগ-বিলাসের প্রতি আগ্রহ, ধনী হবার ও দুনিয়ার মজা লুটবার প্রতিযোগিতা এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, এর ওপর কল্পনাবৃত্তি ও কাব্যের সংশয় জাগে এবং এর কল্পনা কেবল তিনিই করতে পারবেন যিনি প্রাচীন ইরানের ইতিহাস, কাব্য ও সাহিত্য খুব গভীরভাবে পাঠ করেছেন।

মাদায়েন শহর, শাহী প্রাসাদ, বাহার-ই কিসরা৩৩ (সেই কার্পেট যার ওপর বসন্ত মৌসুমে পারস্য সম্রাটগণ মদ পান করতেন), কিসরার রাজমুকুট ও পারস্য সম্রাটদের সঙ্গে যুক্ত খাদেম ও অনুচরবর্গ, স্ত্রী ও দাসীকুল, বালক ও কিশোর সেবকবৃন্দ, বাবুর্চি ও খানসামামণ্ডলী, পশু ও পক্ষীকুলের পরিচর্যাকারী, শিকারের উপকরণ ও বাসন-কোসনের সেসব রূপক বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি সম্পর্কে৩৪ যিনি জ্ঞাত তিনি কেবল এই একটি ঘটনা থেকেই এর পরিমাপ করতে পারবেন যে, মুসলিম বিজয়ের পরিণতিতে ইরানের শেষ শাসক সম্রাট ইয়াযদগির্দ নিজ রাজধানী মাদায়েন থেকে যখন পালিয়ে যান তখন সেই অবস্থায়ও তাঁর সাথে এক হাজার বাবুর্চি, এক হাজার গায়িকা, এক হাজার চাপাতি ব্যবস্থাপক, এক হাজার শকর (বাজ পাখি) দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত অনুচরবর্গ ও মোসাহেবদের একটি বিরাট দল ছিল।

এত বড় বিরাট লোক-লস্কর সত্ত্বেও তিনি একে খুবই নগণ্য সংখ্যক এবং নিজেকে খুবই মামুলি ও তুচ্ছ একজন আশ্রিত মনে করতেন। তিনি অনুভব করতেন, মোসাহেব ও চাকর-বাকরের সংখ্যা, বিলাস-ব্যসন ও ক্রীড়া-কৌতুকের উপকরণের কমতির দরুন তাঁর অবস্থা নিতান্তই করুণার যোগ্য।

অপরদিকে গরিব জনসাধারণের ছিল অত্যন্দ দরিদ্র দশা ও বিপদ। নিজেদের দুর্দশায় কান্নাই ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। ক্ষীণ প্রাণ ও জীর্ণশীর্ণ দেহটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদেরকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো। নানা রকম ট্যাক্স, রকমারি বিধি-নিষেধ ও বেড়ি-বন্ধন তাদের জীবনকে সাক্ষাত জাহান্নামে পরিণত করে দিয়েছিল এবং তারা পশুর মতো জীবন কাটাচ্ছিল। দুঃখ-কষ্টে ও জুলুম-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ঐসব ট্যাক্স ও সৈন্যবিভাগে বাধ্যতামূলক ভর্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বহু কৃষক খেত-খামার ছেড়ে দেয় এবং সাধু-সন্তুদের খানকাহ ও মাঠে গিয়ে আশ্রয় নেয়।৩৫ তারা প্রাচ্যের সাসানী সাম্রাজ্য ও পাশ্চাত্যের বায়যান্টাইন সাম্রাজ্যের দীর্ঘ ও রক্তাক্ত সংঘর্ষে (যা ইতিহাসের বিভিন্ন বিরতিতে চলতে থাকে এবং যে সংঘর্ষ না জনসাধারণের কোন কল্যাণ নিহিত ছিল আর না এতে ছিল তাদের কোন আর্কষণ) নগণ্য ইন্ধন হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।৩৬

৩০. সাসানী আমলে ইরান, মানী ও তার ধর্ম, ২৩৩-৬৯ পৃ.।
৩১. নামায়ে তানাস্যুর থেকে উদ্ধৃত, মীনাবী সং, পৃ. ১৩।
৩২. সাসানী আমলে ইরান, ৩৩৯ পৃ.।
৩৩. তারীখে তাবারী, ৪র্থ খ., ১৭ পৃ.।
৩৪. শাহীন ম্যাকারিয়সকৃত তারীখে ইরান, আরবী সং, ১৮৯৮ পৃ.।
৩৫. শাহীন ম্যাকারিয়সকৃত তারীকে ইরান, ৯৮ পৃ.।
৩৬. সাসানী আমলে ইরান, ৫ম অধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দয়া করে কপি করা থেকে বিরত থাকুন, ধন্যবাদ।