মন খারাপের দিনে :: আরিফ আজাদ

খুব মন খারাপ ? হৃদয়ের অন্দরমহলে ভাঙ্গনের জোয়ার? চারপাশে পৃথিবীটাকে বিস্বাদ আর বিরক্তিকর লাগছে? মনে হচ্ছে আপন মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে? হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় জন, প্রিয় মানুষ? কিংবা অযাচিত অন্যায্য সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত অন্তর?নিন্দুকের নিন্দা হৃদয়ের গভীরে গভীর দুঃখবোধের প্লাবন তাহলে চলুন আমরা ঘুরে আসি অন্য একটা জগত থেকে

 বলেছিলাম সেই সময়কার কথা যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিল সবচাইতে নিকৃষ্ট, নির্দয়, নরপিশাচ  শাসক ফেরাউন।  সম্ভবত, পৃথিবীতে আর কখনোই তার  মত দ্বিতীয় কোন জালিম শাসক কে অবলম্বন করবে না। তার অত্যাচার আর নির্যাতনের মাত্রা ছিল অতি ভয়ংকর। হবেই বা না কেন? নিজেকে ‘খোদা’ দাবি করত।খোদার শান, মান আর মর্যাদার আসনে কল্পনা করে সে নিজেকে জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ধরে নিত।  তার এই মিথ্যে দাবির সাথে যারাই দ্বিমত করত, তাদের কপালে জুটত- মৃত্যু! সে মৃত্যুগুলো কোন সাধারণ মৃত্যু ছিল না। কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারতো, কাউকে পানিতে চুবিয়ে মারতো। যেন মৃত্যুর বাহারি আয়োজনে ভরপুর থাকত তার সংসদ।

 ফেরাউন ধরে ধরে বনি ইসরাইলের পুত্রসন্তানদের হত্যা করত। ফিরাউন জানত, তাকে বদ করার জন্য এই বনি ইসরাইলের মধ্যেই সত্য ইলাহের একজন সত্য নবি হবে বনি ইসরাইলের ঘরে জন্ম নেওয়া সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করতে পারলেই তার পথের কাঁটা সাফ  প্রেরিত হবে। সে ভাবত, বনি ইসরাইলের ঘরে জন্ম নেওয়া সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করতে পারলেই তার পথের কাঁটা সাফ করে ফেলা যাবে। এই নিষ্ঠুর, নির্দয় জালিমের হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল শিশু মুসার মায়ের অন্তর। চোখের সামনে প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন করা দুনিয়ার কোনো বাবা-মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। কীভাবে বাঁচাবেন পুত্রকে তিনি? কীভাবে তাকে আড়াল করবেন জালিম বাহিনীর নাগপাশ থেকে? অস্থির চঞ্চলা হয়ে পড়লেন তিনি। মুসার মায়ের হৃদয়ের এই ব্যাকুলতা  আল্লাহর কাছে গোপন থাকলো না। তিনি শিশু মুসা আলাই সালাম কে একটা বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য মুসার মাকে নির্দেশ দিলেন। ব্যাপারটা কুরআনে এসেছে। আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা বলেছেন-

وَأَوْحَيْنَآ إِلَىٰٓ أُمِّ مُوسَىٰٓ أَنْ أَرْضِعِيهِ ۖ فَإِذَا خِفْتِ عَلَيْهِ فَأَلْقِيهِ فِى ٱلْيَمِّ

 আর আমি মুসার মায়ের নিকট এই মর্মে নির্দেশ পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে। (সুরা কাসাস, আয়াত : ০৭)

 চিন্তা করুন একদিকে ফেরাউন বাহিনীর হাত থেকে সন্তানকে প্রাণে বাঁচাতে মায়ের অন্তর মরিয়া। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, শিশুটাকে যেন বাক্সবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে, এ যেন মৃত্যুর আগেই মৃত্যুবরণ করে নেওয়া। ডাঙার বাঘের ভয়ে জলের কুমিরের সামনে সন্তানকে ঠেলে দেওয়ার মত ব্যাপার। আমার এবং আপনার মনে যে ভাবনার উদয় হচ্ছে তা কি মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও উদয় হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছে। তবে, তার মনের সেই ভীতি, সেই ভয়, সেই সন্দেহ তখনই দূর হয়ে গেল, যখন তিনি আল্লাহর কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে পেলেন। সুমহান আল্লাহ বলেন-

وَلَا تَخَافِى وَلَا تَحْزَنِىٓ ۖ إِنَّا رَآدُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ ٱلْمُرْسَلِينَ

 আর একদম ভয় করবে না এবং চিন্তাও করবে না। নিশ্চয় আমি তোমার সন্তানকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেব এবং তাঁকে রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করব (সুরা কাসাস, আয়াত : ০৭)

 ওই জায়গায় আমি কিংবা আপনি হলে যে ভয় এবং যে ভীতি আমাদের অন্তরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরত, একই ভয় মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও জেঁকে বসেছিল। তবে তিনি হতোদ্যম হয়ে যাননি। আশা ছেড়ে দেননি। তিনি চোখ মুখ বন্ধ করে এমন এক সত্তার উপর ভরসা করেছিলেন যার দেওয়া আশা কখনো মিথ্যা হয় না। যিনি কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এরপর ফলাফল কি হলো তা আমরা সকলেই জানি। মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়াতা’য়ালা রক্ষা করেছিলেন। কেবল রক্ষাই করেননি, যে শত্রু হন্যে হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসেছিল, সেই শত্রুর অন্দরমহলেই শিশু মূসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তা’য়ালা বড় করে তুলেছিলেন। এ পরিকল্পনা কার? কে এমন নিখুঁত পরিকল্পনা করার ক্ষমতা রাখেন? তিনি সুমহান আল্লাহ।

وَمَكَرُوا۟ وَمَكَرَ ٱللَّهُ ۖ وَٱللَّهُ خَيْرُ ٱلْمَـٰكِرِينَ

 তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ কৌশল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী (সুরা আল-ইমরান, আয়াত: ৫৪)

 আমরা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর ঘটনাও স্মরণ করতে পারি।  শিশু ইউসুফ ছিলেন পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। ইউসুফের প্রতি পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের এই অবর্ণনীয় ভালোবাসাকে কোনভাবে মেনে নিতে পারেননি তাঁর অন্য  সহোদরেরা। হিংসার বশবর্তী হয়ে, খেলার নাম করে তারা ছোট্ট ইউসুফকে ফেলে দেয় এক অন্ধকার কূপের মধ্যে।

 পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর কাছে এসে তারা খুব সুন্দর কাহিনী ফেঁদে বসল। বলল, ‘বাবা, খেলার মাঠ থেকে ইউসুফকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে!’ ইয়াকুব আলাইহিস সালাম জানতেন, তাঁর ছেলেরা তাঁর কাছে এসে মিথ্যা কথা বলছে। তিনি এটাও জানতেন, তারা নিশ্চিত ইউসুফের কোন ক্ষতি করে বসেছে। এতদসত্ত্বেও তিনি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করলেন না। প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে হারানোর বেদনায় মাথা চাপড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন না। এমনকি ছেলেদের তিঁনি কোনো কটু কথা, কোনো হুমকি-ধমকি পর্যন্তও দিলেন না। তিঁনি কী বলেছিলেন জানেন? কুরআনে এসেছে-

فَصَبْرٌۭ جَمِيلٌۭ ۖ وَٱللَّهُ ٱلْمُسْتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ

 সুতরাং, আমার করণীয় হচ্ছে সুন্দর এবং সুস্থিরভাবে ধৈর্যধারণ করা। আর তোমরা আমার কাছে যা বর্ণনা করেছ, সে বিষয়ে আল্লাহই হলেন আমার একমাত্র সাহায্যদাতা (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮)

 আল্লাহর উপর ভরসার পারদ কতটা উঁচুতে থাকলে এমন মুহূর্তে একজন বাবা এ রকম কথা বলতে পারে?  এভাবে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে পারে? আর সেই ধৈর্যের  বিনিময়  কতটা বিশাল  ছিল তা তো আমরা জানি। ইউসুফ আলাইহিস সালামকে পরবর্তীকালে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মিশরে অধিষ্ঠিত করেন রাজার বিশ্বস্ত লোক হিসেবে। যে ভাইগুলো তার সাথে শত্রুতা করে একদিন তাকে কূপে ফেলে দিয়েছিল, তাদেরকেই তিনি তার পায়ের কাছে এনে ফেলেছিলেন। তিনি ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়তম পুত্র ইউসুফ কে, আর ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়তম পিতা কে। সুবহানাল্লাহ! কত সুন্দর আল্লাহর জুড়ে দেওয়া মেলবন্ধন! কত চমৎকারই-না বিপদে ধৈর্য ধারনের ফল 

সুতরাং, দুনিয়াবী কষ্ট গুলোতে, ‘না পাওয়া’ ও ‘হারিয়ে ফেলা’ গুলোতে একজন মুমিন কখনোই হতাশ হবে না। চরম বিপদের মুহূর্তে, উভয় সংকটের সময় মুসা আলাইহিস সালাম এর মাতা আল্লাহর দেয়া ফয়সালাই মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন এবং অপেক্ষা করেছিলেন আল্লাহর কৃত ওয়াদার ফললাভের জন্য। পুত্র হারানোর শোকের দিনেও নবী ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দেখিয়েছেন ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা। আল্লাহ তাদের কাউকেই হতাশ করেননি। আন্তরিক সবর এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল তথা ভরসা করার জন্য আল্লাহ তাঁদের উত্তম বিনিময় প্রদান করেছেন।  মূসা আলাইহিস সালামের  মাতার  যিনি রব, তিনি আপনারও রব। যিনি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের প্রতিপালক, তিনি আপনারও প্রতিপালক। মুসার মাতা যার উপরে ভরসা করেছিলেন, আপনিও তাঁর উপরে ভরসা করুন। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু যেখানে, আপনিও ঠিক সেই জায়গায় আপনার সমস্ত আশা আর ভরসাকে সমর্পন করুন। যিনি মুসার মাতার অন্তরকে প্রশান্ত করতে পারেন, তিনি কি আপনার ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাওয়া হৃদয়ে প্রশান্তির ফল্গুধারা বইয়ে দিতে পারেন না? যিনি মুসা আলাইহিস সালামকে তার চরম শত্রুর ঘরের মধ্যে বড় করে তুলতে পারেন, তিনি কি চাইলে আপনার দুঃখ, আপনার ব্যথা উপশম করে দিতে পারেন না? যে মহান রব মুসার মাতার আর এয়াকুব আলাইহিস সালামের ভরসার প্রতীক হয়েছিলেন, আস্থার প্রতীক হয়েছিলেন, সেই রবকে আপনিও আপনার সকল আশা-ভরসার প্রতীক বানিয়ে ফেলুন। জীবনের সমস্ত দুর্যোগে কেবল তাঁর  উপরই ভরসা করুন। দেখবেন আপনার জীবন এক অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে গেছে

 

 মানুষ হিসেবে আপনার অবশ্যই জানা উচিত- এই দুনিয়া আপনার জন্য কখনোই নির্মল আর নির্ঝঞ্ঝাট হবে না। জীবনের একটা পরম বাস্তবতা হলো জীবন কখনোই রেল লাইনের মতো সমান্তরাল হয় না। এই জীবন হলো দুঃখ-ক্লেশ-কষ্ট দিয়ে গড়া। দুনিয়ার সবাইকে আপনি কখনোই আপনার বন্ধু হিসেবে পাবেন না। সবচাইতে পবিত্র, সবচাইতে তাকওয়াবান ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লামও তাঁর চারপাশের সবাইকে কখনোই বন্ধু হিসেবেপাননি। তিনি ছিলেন ‘আল-আমিন’ তথা বিশ্বস্ত। সবার কাছে ন্যায় এবং আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা লোকটিরও সমালোচক ছিল। নিন্দুক ছিল।কুৎসা   রটনাকারী ছিল। মানুষের সমালোচনার তীর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেও বিদ্ধ করতে ছাড়েনি। নবীজি যখন সমালোচকদের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত, যখন তাঁর হৃদয় ভারী হয়ে উঠেছিল মানুষের কটু কথা আর কটু বাক্যে, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন

 

وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ ⚫فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُن مِّنَ ٱلسَّـٰجِدِينَ

 আর আমি তো জানি তারা যা বলে তাতে আপনার অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়। সুতরাং, আপনি আপনার রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করুন আর অন্তর্ভুক্ত হোন সেজদাকারীদের (সুরা হিজর, আয়াত: ৯৭-৯৮)

 স্বয়ং নবীজিকে যেখানে সমালোচনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, সেখানে আপনি বা আমি কিভাবে ধরে নিতে পারি যে, আমাদের সমালোচক থাকবে না নীরব থাকবে না? নিন্দুক থাকবে না? আমাদের পেছনে কুৎসা রটনাকারী থাকবে না? বস্তুত এটাই হলো জীবন! এর জবাবে আমাদের প্রতিউত্তর কি হবে? আল্লাহ শিখিয়ে দিচ্ছেন,তাসবীহ  পাঠ এবং সালাত আদায়। এতেই রয়েছে ক্ষতবিক্ষত অন্তরের দুঃখ সারানোর উপশম। ভগ্নহৃদয় পুনর্নির্মাণের মহৌষধ। নবীজিও আল্লাহর বাতলে দেওয়া উপায়েই হৃদয়কে প্রশান্ত করেছেন। মানুষের অযাচিত সমালোচনায় যখন তাঁর হৃদয় বেদনার ভারে নুইয়ে পড়তো, তখন তিঁনি বিলাল রাদিআল্লাহু আনহু কে সালাতের জন্য ডাকতেন আর বলতেন, ‘বিলাল, সালাতের মাধ্যমে আমাদের অন্তরকে প্রশান্ত করো। (৬)

 যখন কেউ আপনার নামে কুৎসা রটাবে, অনর্থক আপনার নামে সমালোচনা করবে, তখন আপনি ধৈর্যহারা হবেন না। হতবিহ্বলহয়ে পড়বেন না। সবর করবেন। এই সবরের ফল সুমিষ্ট। আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহার ব্যাপারে দেওয়া মুনাফিকদের  অপবাদের কথা কি মনে আছে? একবার এক সফরের সময় তিঁনি কাফেলা থেকে একটু পিছিয়ে পড়েন। তিনি যে কাফেলা থেকে ছিটকে পড়েছেন সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। এরপর জনশূন্য সেই প্রান্তরে  তিনি ঠিক কী করবেন এমন ভাবনার দোলাচলে সময় যেতে লাগলো। একসময় তিঁনি সেখানটায় ঘুমিয়ে পড়েন। পরে, সাফওয়ান ইবনু সুলামি ওই পথ অতিক্রম করার সময় আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা কে দেখতে পান এবং তাঁকে সাথে নিয়ে পুনরায় কাফেলায় যোগ দেন।

 এই ঘটনাকে নিয়ে কুৎসা রটিয়ে বেড়ায় মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই। সে প্রশ্ন তোলে আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার পবিত্র চরিত্র নিয়ে! শুনতে অবাক লাগলেও সত্য, মুনাফিকদের এই কুৎসা, এই সমালোচনা এবং তিরস্কার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আযয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার মাঝে সাময়িক দূরত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নবিজি বুঝতে পারছিলেন না, সমালোচকদের তিনি কি জবাব দিবেন। কিভাবেই-বা প্রমাণ করবেন যে, আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা একজন সতী-সাধ্বী নারী! তাছাড়া, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যা প্রচার করে বেড়াচ্ছে তার সত্য-মিথ্যার ব্যাপারেও তিনি সন্দিহান। তিনি কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করলেন। এমন দোটানা পরিস্থিতি, এমন বিপন্ন সময়ে তিনি এক মহামহিম আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছেন। হযরত আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ও তাই করলেন। কারো সাথে কোনো বিরোধ করেননি। কোথাও উচ্চবাচ্য করেননি। চোখের জল ফেলে কেবল আল্লাহর কাছে নিজের সমস্ত অভিযোগ, সমস্ত বাসনা সোপর্দ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা কি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা কে নিরাশ করেছেন? হতাশ করেছেন? মুনাফিকদের বিরুদ্ধে, সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে, কুৎসা রটনাকারী দের বিরুদ্ধে সাহায্য করেননি? অবশ্যই করেছেন। ওহী নাজিল করে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহার চরিত্রের ব্যাপারে মুনাফিকদের সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ ٱلَّذِينَ جَآءُو بِٱلْإِفْكِ عُصْبَةٌۭ مِّنكُمْ ۚ

নিশ্চয় যারা এই অপবাদ রচনা করেছে তারা তোমাদের ওই একটি দল। (সুরা নুর, আয়াত : ১১)

 এটা যে একটি অপবাদ, কুৎসা এবং জিঘাংসা, সেটা আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। এভাবেই তো আল্লাহ তাঁর  মুমনি ব্যক্তিদের সাহায্য করে থাকেন। কখনো স্পষ্ট সাহায্য আবার কখনো বা অস্পষ্ট সাহায্য।

 জীবনে আপনিও আপনার চারপাশে একটি দল পাবেন যারা সর্বদা আপনার সমালোচনায় মুখর থাকবে। গভীর পর্যবেক্ষণের দ্বারা আপনার ভালো কাজটির খুঁত বের করবে। আপনার ত্রুটিযুক্ত কাজটিকে ফলাও করে প্রচার করে বেড়াবে, যাতে আপনাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়া যায়। যাতে আপনি হতাশ হয়ে পড়েন। আপনার মন যাতে বিষিয়ে ওঠে। এ সবকিছুই তারা আপনার প্রতি হিংসা, ঈর্ষা আর জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে করে থাকে; কারণ, আপনার অবস্থান তাদের   পীড়া দেয়। আপনার গ্রহণযোগ্যতা তাদের মনে বিষাক্ত ফলার মতো আঘাত করে। আপনাকে আপনার অবস্থান থেকে নামিয়ে আনার চিন্তায় তারা সদা বিভোর থাকে- কিভাবে অন্যদের চোখে আপনাকে খাটো করা যায়, কিভাবে অন্যদের মনে আপনার ব্যাপারে সন্দেহের বীজ বুনে দেওয়া যায়।

 এদের ব্যাপারে কখনোই হতাশ হবেন না। এদের কথায় মন খারাপ করবেন না। ভেঙে পড়বেন না। হতোদ্যম হবেন না। এদের কথা কিংবা বক্তব্যের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। শুধু সবর করবেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদের ক্ষমা করে দিবেন। নিজের এবং তাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন। ব্যাস! আপনার কাজ কেবল এতোটুকুই। এ রকম অবান্তর সমালোচনায় পতিত হলে নিজের সাথে কথা বলুন। ভেবে দেখুন তো, আপনার ইখলাস আর নিয়ত আপনার কাছে পরিশুদ্ধ মনে হয় কি না? যদি অন্তরের ভেতর থেকে এই কথা প্রতিধ্বনিত হয় যে, ‌’আমি তো এই কাজ আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্যই করেছি’ তাহলে নিশ্চিত মনে আপনার পরবর্তী কাজে মনোযোগ দিন। এ রকম বিশুদ্ধ নিয়তের কারণে ভুল কাজটার জন্যও আপনার আমল নামায় হয়তো সাওয়াব যোগ হয়ে গেছে।

 মন খারাপের দিনগুলোতে আল্লাহর সাথে বেশি বেশি কথা বলুন কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে, সালাতের সেজদার মাধ্যমে। আল্লাহকে বলুন তিনি যেন আপনার অশান্ত মনটাকে প্রশান্ত করে দেন। তাঁকে অনুনয়-বিনয় করে বলুন, বুকের মধ্যে যে কালবৈশাখী ঝড় আপনার মনের  উঠোনটাকে তছনছ করে দিচ্ছে, সেই কালবৈশাখী তিনি যেন থামিয়ে দেন। সেখানে যেন রহমতের বারিধারা প্লাবিত হয়। একটিবার নিজের জীবনে কুরআনকে জায়গা করে দিন। দেখবেন, জীবনের গতিপথ কিভাবে পাল্টে যায়। কুরআনের সারনির্যাসকে একবার নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেই দেখুন না। দেখবেন আপনার জীবনটা অন্যরকম এক শীতলতায় ভরে উঠেছে। দুনিয়ার মানুষ যে অন্তর ভেঙ্গে দেয়, আল্লাহ সুবাহানাহু তা’য়ালা সেই অন্তর ভালোবাসার প্রলেপে জোড়া লাগিয়ে দেন।

 আপনার মনে হচ্ছে আপনি ব্যর্থ হয়ে গেছেন,  তাই না? মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা আপনার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে। জীবনের কোন মানে খুঁজে না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত আপনার তনুমন, এই তো? কোরআন খুলুন। দেখুন আপনার রব আপনার জন্যই বলছেন-

قَدْ أَفْلَحَ ٱلْمُؤْمِنُونَ

অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়েছে। (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ০১)

 

 আপনি একজন মুমিন। একজন বিশ্বাসী। একজন তাকওয়াবান। আপনি তো হতাশ হতে পারেন না। আল্লাহর দয়া থেকে, তাঁর করুণা, ভালোবাসা এবং রহমতের যে বারিধারা আপনার উপর বর্ষিত হচ্ছে, তা থেকে আপনি কিভাবে নিরাশ হবেন? দুনিয়াবী ব্যর্থতা, অসফলতা আপনার কি আসে যায়, বলুন? আল্লাহর উপর যারা ভরসা করে, নির্ভর করে, তারা হতাশ হয় না। দুনিয়ার ব্যর্থতা তাদের আঘাত দেয় না। তারা বরং অপেক্ষার  প্রহর গুনে মহাসাফল্যের। সেই সাফল্যের, যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামিন। আপনার হৃদয় যখন আল্লাহর উপর ভরসায় টইটুম্বুর, তখন সিজদায় যাকারিয়া আলাইহিস সালাম এর মত করে বলুন-

وَلَمْ أَكُنۢ بِدُعَآئِكَ رَبِّ شَقِيًّۭا

 হে আমার রব আমি তো কখনো তোমাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি (সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৪)

 আপনার  জীবনে অনেক দুঃখ আসতে পারে। আপনি মুখোমুখি হতে পারেন নানান ঝঞ্চাক্ষুব্ধ ঝড়ের। কোন কোন ঝড়ো হাওয়া এসে আপনার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়ে যাবে। অস্ফুট স্বরে মহান রব্ কে যখন বলেন, ‘মালিক! আমার জীবনে এত কষ্ট কেন? তিনি তখন বলেন-

إِنَّ مَعَ ٱلْعُسْرِ يُسْرًۭا

 নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত: ০৬)

এমন কঠিনতর বিপদে আশেপাশে কাউকে পাচ্ছেন না। এমনকি অন্ধকারে আপন ছায়াটাও মিলিয়ে যায়। আপনার এতদিনের সুহৃদ, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় স্বজনদের কেউই এই দুর্দিনে আপনার পাশে নেই। নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অকূল দরিয়ায় একটি ডুবুডুবু নৌকার আপনি একাই যাত্রী। এই নৌকা যেকোনো মুহূর্তেই তলিয়ে যাবে। এমন সময়ে আপনি যখন আশাহত হয়ে রবের কাছে ফরিয়াদ করে বলেন, ‘মাবুদ! আজকে আমাকে সাহায্য করার মতন কেউই নেই।’ তখন আপনার রব বলেন-

وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ ٱلْمُؤْمِنِينَ

মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব (সুরা রুম, আয়াত: ৪৭)

প্রিয়জনেরা বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দূরে চলে গেছে। জীবন নামক চোরাবালির সাথে আপনি আর কোনোভাবেই পেরে উঠছেন না। খুব অসহায়বোধ করছেন। মনে হচ্ছে, আপনি এক্ষুনি ডুবে যাবেন দুঃখের অতল গহ্বরে। হারিয়ে যাবেন চিরতরে। তখন যদি মুখ ফুটে বলেন, ‘আল্লাহ! আমার পাশে আজ কেউই আর অবশিষ্ট নেই’। তখন আপনার ডাক শুনে আল্লাহ বলেন-

لَا تَخَافَآ ۖ إِنَّنِى مَعَكُمَآ أَسْمَعُ وَأَرَىٰ

ভয় পেয়ো না! আমি তোমাদের সাথেই আছি। আমি সব শুনি এবং দেখি । (সুতা ত্ব-হা, আয়াত: ৪৬)

পাপে জর্জরিত হয়ে আছে জীবন। চোখ মেললেই চারদিকে কেবল অন্ধকারের ঘনঘটা দেখতে পান। কলুষিত হৃদয় নিয়ে যখনই আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি যে এত পাপ করেছি, আল্লাহ কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করবেন?’ তখনই আপনার রব জবাব দেন- 

إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ

নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন (সুরা বাক্বারাহ, আয়াত: ২২২)

এভাবেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা প্রতিটি সময়ে, প্রতিটি মুহূর্তে আপনার পাশে থাকেন। আল্লাহর কালামকে, তাঁর বাণীকে জীবনে ধারণ করুন। আল্লাহকে জীবনে বন্ধু বানিয়ে নিন। বিশ্বাস করুন, বন্ধু হিসেবে তাঁর চেয়ে উত্তর , তাঁর চেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল, তাঁর চেয়ে মহান আর কেউ হতেই পারে না। নিজের জীবনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলোর রেখা প্রবেশ করতে দিন। অন্ধকারকে আলো দ্বারা  দূরীবূত করুন। আপনার যে পৃথিবী এতদনি এক ঘনঘোর আঁধারে  নিমজ্জিত ছিল তা উদ্ভাসিত হবে সম্পূর্ণ নতুন এক রূপে। নতুন এক রঙে। মন খারাপের দিনগুলোতে আল্লাকে আপনার সঙ্গী বানান, দেখবেন সে মুহূর্তগুলো সব আচমকা আপনার জীবনের সেরা মুহূর্তে  পরিণত হয়ে গেছে। তাই যে দুঃখগুলোর কথা কাউকে বলতে পারছেন না, যে দুশ্চিন্তার অনলে আপনি দগ্ধ হচ্ছেন প্রতিদিন, যে ভয় আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে অহরহ, হারানোর যে বেদনা আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, যে অস্থিরতা আপনাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না, যে ভগ্নহৃদয় আপনাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে, সে সমস্ত মন খারাপের গল্পে কেবল বলুন, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়ানি’মাল ওয়াকিল।’ আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট। বিশ্বাস করুন, আপনার সমস্ত মনখারাপের উপশমের জন্য কেবল এটুকুই যথেষ্ট। আল্লাহ যার অভিভাবক, কপালে তার দুশ্চিন্তার ভাঁজ থাকতেই পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দয়া করে কপি করা থেকে বিরত থাকুন, ধন্যবাদ।