সাহাবীদের প্রতি হাবশায় হিজরতের নির্দেশ:

সারওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর নিজের উপর যত ধরনের অত্যাচার-নিপীড়ন করা হয়েছে, তিঁনি তার সবই সহ্য করে এসেছেন। কিন্তু যখন তিঁনি দেখলেন, সাহাবায়ে কেরাম এবং আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত এ অত্যাচারের মাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাঁরাও অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সকল অত্যাচার সহ্য করে নিতে প্রস্তুত রয়েছেন, তবুও সেই সত্যবাণী এবং আল্লাহ প্রদত্ত নূর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে তারা মোটেই সম্মত নন, যে সত্য ও নূর তাঁরা নবী করীম (সাঃ) এর মাধ্যমে পেয়েছেন, তখন তিঁনি তাঁদের এদেশ ছেড়ে হাবশায় চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

নবুয়ত লাভের পঞ্চম বছর রজব মাসে বারজন পুরুষ এবং চারজন মহিলা হাবশায় হিজরত করেন,(২) যাদের মধ্যে হযরত উসমান (রা.) এবং তাঁর স্ত্রী হযরত রুকাইয়া (রা.) ও ছিলেন। -[দুরুসুস সীরাত, পৃষ্ঠা-১৫]

হাবশার বাদশাহ নাজাশী (৩) হিজরতকারীদের যথেষ্ট সমাদর করলেন।তাঁরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে সেখানে বাস করতে লাগলেন। যখন কুরাইশরা এ সম্পর্কে জানতে পারল, তখন তারা আমর ইবনে আস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে  রাবিআ’কে নাজাশীর নিকট এই বলে পাঠাল যে, এরা দুষ্কৃতকারী, এদেরকে আপনি আপনার রাজ্যে থাকার অনুমতি দেবেন না, বরং তাদেরকে আমাদের হাতে সোপর্দ করে দিন।

নাজাশী ছিলেন খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি তাদের এ কথার উত্তরে বললেন, “আমি এ কাজ সে সময় পর্যন্ত করতে পারব না, যে পর্যন্ত আমি তাদের ধর্ম ও তাদের ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে না পারব।” এরপর হিজরতকারী সাহাবীদের নিকট যখন নাজাশী বাদশাহ জানতে চাইলেন যে, “নিজেদের ধর্ম এবং এর সঠিক বিবরণ আমার কাছে বর্ণনা করুন।” তখন আবূ তালিবের পুত্র হযরত জাফর (রা.) (৩) সামনে এগিয়ে এসে বললেন, “হে বাদশাহ! আমরা পূর্বে অজ্ঞানতার মাঝে ডুবে ছিলাম, আমরা মূর্তি পূজা করতাম, মৃত জীবজন্তু ভক্ষণ করতাম, নানা ধরনের অশ্লীলতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং দুশ্চরিত্রতায় লিপ্ত ছিলাম। আমাদের সবলেরা দুর্বলদের গ্রাস করত।”

‘এমনি পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলা আমাদের নিকট এক রাসূল পাঠালেন, তিনি আমাদেরই বংশের লোক। আমরা তাঁর বংশ-গোত্র, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা এবং চারিত্রিক পবিত্রতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানি। তিঁনি আমাদের  আহ্বান জানারেন, যেন আমরা আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করি, আর কাউকে তাঁর সমতুল্য বা অংশীদার বলে মনে না করি, মূর্তি পূজা পরিত্যাগ করি, আমরা যেন সত্য কথা বলি, আত্মীয়-পরিজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখি এবং প্রতিবেশীদের সাথে সদারছন করি। তিঁনি আমাদের যাবতীয় হারাম এবং অবৈধ কাজ করতেত নিষেধ করেছেন। অনর্থক রক্তপাত, মিথ্যা কথা বলা এবং এতিম-অনাথদের সম্পদ গ্রাস করা থেকে ফিরিয়েছেন। আমাদের নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্ব ব্রত পালন করতে আদের্শ দিয়েছেন। আমরা যখন তাঁর এসকল কথা শুনেছি, তখন তাঁর উপর ঈমান এনেছি।”

নাজাশী (৪) এ ভাষণে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন, কুরাইশদের ঐ দুজন প্রতিনিধিকে ফিরিয়ে দেন এবং নিজে মুসলমান হয়ে যান। হিজরতকারী সাহাবীগণ প্রায় তিনমাস সে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে অবস্থান করার পর মক্কায় ফিরে আসেন। এ সময় হযরত ওমর (রা.)ও, নবী করীম (সাঃ) এর দোয়ার বরকতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ সময় পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশজন পুরুষ এবং এগারজন মহিলার অধিক ছিল না। ফারুকে আযম হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার কারণে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পেল এবং যে সকল লোক সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের সাহায্যে ইসলামের সত্য ধর্ম হওয়াকে মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিলেও কুরাইশদের অত্যাচার-নিপীড়নের ভয়ে এতদিন পর্যন্ত ইসলামকে প্রকাশ করতে পারেনি, তারা এখন প্রকাশ্যে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগল। এভাবেই আরবের বিভিন্ন গোত্রে ইসলামের প্রচার-প্রসারও উন্নতি হতে লাগল।

যখন কুরাইশরা দেখতে পেল যে, নবী করীম (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের ইজ্জত-সম্মান দিন দিন বেড়েই চলছে এবং হাবশার বাদশাহ তাঁদের যথেষ্ট সম্মান ও সমাদর করছেন, তখন তারা নিজেদের শেষ পরিণতি সভয়ে নিজেরাই প্রত্যক্ষ করতে লাগল। তাই কুরাইশরা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, বনূ আব্দুল মুত্তালিব এবং বনূ হাশিম গোত্রের নিকট এ দাবি জানানো হবে যে, হয় তারা তাদের ভ্রাতুষ্পুত্র (হযরত মুহাম্মদ সাঃ) কে আমাদের হাতে তুলে দেবে, নয়তো আমরা সবাই তাদের সাথে সম্পূর্ণবাবে সম্পর্ক ছিন্ন করব।

কিন্তু বনূ আব্দুল মুত্তালিব তাদের এ প্রস্তাব কবুল করল না। তখন সকলের ঐক্যমতে এ অঙ্গীকারনামা(৫) লেখা হলো যে, বনূ হাশিম এবং বনূ আব্দুল মুত্তালিবের সাথে পুরোপুরিভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখা, বিয়ে-শাদি, কেনাবেচা ইত্যাদি সব বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ অঙ্গীকারনামা কা’বা শরীফের ভেতর ঝুলিয়ে দেওয়া হলো।

একটি পাহাড়ের উপত্যকায় নবী করীম (সাঃ) এবং তাঁর সকল বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে আবদ্ধ করে রাখা হলো। সে সময় একমাত্র আবূ লাহাব ব্যতীত বনূ হাশিম ও বনূ আব্দুল মুত্তালিবের সকলে, মুসলমান ও কাফের নির্বিশেষে সবাই আবূ তালিবের সাথে থাকে। ফলে সবাই ঐ উপত্যকায় বন্দি ও আবদ্ধ জীবন কাটাতে হয়।

সকল দিক থেকে রাস্তা বন্ধ ছিল। খাওয়া দাওয়ার যে দ্রব্যাদি তাদের সাথে ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল। ভীষণ দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার সৃষ্টি হলো। ক্ষুধায় তাড়নায় গাছের পাতা খাওয়ার মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটল।

এমনি দূরবস্থা দেখে নবী করীম (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে পুনরায় হাবশায় হিজরত করতে বললেন। এবার বড় এক কাফেলা হিজরত করলেন, যাদের মধ্যে তিরাশি জন পুরুষ এবং বার জন মহিলা ছিলেন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের সাথে ইয়েমেনের মুসলমানরাও এসে মিলিত হন, যাদের মধ্যে হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা.) এবং তাঁর বংশীয় লোকজনও ছিলেন।

এদিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং তাঁর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব প্রায় তিন বছর এ অত্যাচার, উৎপীড়ন ও দুঃখ-কষ্টের মাঝে কাটান।(৬) এরপর কিছু লোক এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করেত এবং নবী করীম (সাঃ) এর উপর থেকে অবরোধ তুলে নিতে উদ্যোগী হয়। অপরদিকে ওহী মারফত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জানানো হয় যে, এ অঙ্গীকারনামাটি উঁইপোকা কেয়ে ফেলেছে, আল্লাহর নাম ব্যতীত তাতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তিনি লোকদের এ সংবাদ দিলে তারা গিয়ে দেখল, নবীজী (সাঃ) যেমন বলেছেন, তেমনই ঘটনা ঘটেছে। অবশেষে এ অবরোধ তুলে নেওয়া হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দয়া করে কপি করা থেকে বিরত থাকুন, ধন্যবাদ।