রোমান সাম্রাজ্যে ধর্মীয় গৃহযুদ্ধ

মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো

মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো

পরবর্তীকালে খৃষ্টধর্মের মৌলিক ও পার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয়ে এমন প্রবল বিতর্ক ও কলহ দানাবেঁধে উঠেছিলো যে, গোটা জাতির চিন্তা-চেতনা তাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। যদিও তাতে অন্তসার বলে কিছু ছিলো না তবু তা গোটা জাতির মেধা, যোগ্যতা ও কর্মশক্তি একরকম গ্রাস করে ফেলেছিলো। এসব তর্কযুদ্ধ সুযোগে সুযোগে অস্ত্রযুদ্ধের ভয়াল রূপ ধারণ করতো, যার পরিণতি ছিলো নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা ও রক্তপাত। মানুষের জানমাল, এমনকি ইজ্জত-আবরু পর্যন্ত লুণ্ঠিত হতো ধর্মান্ধদের হাতে। গীর্জা ও ধর্মচর্চার কেন্দ্রগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী ও যুদ্ধমান ধর্মীয় দল-উপদলের সমরশিবিরে পরিণত হয়েছিলো। এভাবে গোটা সাম্রাজ্য নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধে। এই ধর্মীয় বিরোধ-বিবাদের উৎকটতম প্রকাশ ঘটেছিলো রোমান ও সিরিয়ান এবং মিশরীয় খৃষ্টানদের মধ্যে; আরো সঠিক ভাষায়, রাজধর্ম ও মানুবাদের মধ্যে। রাজধর্মের মূল বিষয় ছিলো যিশুখৃষ্টের দ্বৈতসত্তায় বিশ্বাস, পক্ষান্তরে মানুবাদীরা বিশ্বাস করতো, তিনি একটিমাত্র সত্তা ধারণ করেন, অর্থাৎ ইশ্বরীয় সত্তা, যার মাঝে তাঁর মানবীয় সত্তা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে; বড় জলপাত্রে একফোঁটা দুধ যেমন।

দু’দলের এ বিরোধ-সঙ্ঘাত খৃষ্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে এমনই চরম আকার ধারণ করেছিলো, যেন তা পরস্পরের বিনাশকামী দু’টি ভিন্ন ধর্মের যুদ্ধ, কিংবা (কোরআনে বর্ণিত) ইহুদী-নাছারাদের বিরোধ, যাতে ইহুদীদের দাবী ছিলো, নাছারারা কোন ধর্মের উপর নেই, আর নাছারাদের জবাব ছিলো, ইহুদীরা কোন ধর্মের উপর নেই।

ডঃ আলফ্রেড জি, বাটলার বলেন-

‘ঐ দু’টি শতাব্দী ছিলো মিশরীয় ও রোমানদের মধ্যে লাগাতার রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত-সঙ্ঘর্ষের যুদ, যার ইন্ধন ছিলো জাতিগত ভিন্নতা এবং ধর্মীয় বিরোধ, তবে দ্বিতীয়টিই ছিলো প্রবলতর। কেননা সে যুগের সর্বরোগের মূলই ছিলো রাজবাদ ও মানুবাদের হিংস্রতা। প্রথমটি ছিলো, যেমন নাম থেকে বোঝা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের রাজধর্ম এবং সার্বজনীন প্রজাধর্ম, যার মূলকথা হলো যিশুখৃষ্টের স্বভাবসত্তার দ্বৈততা। এ ধর্মবিশ্বাস ছিলো সনাতন ও পরম্পরাপূর্ণ। পক্ষান্তরে মিশরীয় মানুবাদীরা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করতো; এমনকি এর প্রতিরোধে তারা এমন পাশবিক উন্মত্ততা ও জিঘাংসার পরিচয় দিয়েছিলো যা আমাদের পক্ষে আজ কল্পনা করাও সম্ভব নয়। পবিত্র  ইন্জীলে বিশ্বাসীরা দূরে থাক, নূন্যতম বিবেকের অধিকারী কোন সম্প্রদায়ও কীভাবে পাশবিকতার এমন স্তরে নামতে পারে তা ভেবে পাই না।

ছয়শ আটাশ খৃষ্টাব্দে পারসিকদের উপর বিজয় লাভের পর সম্রাট হিরাক্লিয়াস (৬১০-৬৪১) সাম্রাজ্যের বিবাদমান ধর্মসম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্যবিধান ও সমন্বয়সাধনের এক জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার সমন্বয়-প্রচেষ্টার ভিত্তি ছিলো যিশুখৃষ্টের স্বভাব ও সত্তার প্রকৃতি সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনা ও বিতর্ক পরিহার করা। অর্থাৎ তিনি কি একক সত্তার অধিকারী না দ্বৈত সত্তার, এ বিষয়ে কোন পক্ষ নিজস্ব মত প্রচার করবে না; তবে সকল পক্ষের জন্য এ বিশ্বাস গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক যে, ‘ঈশ্বর’- তাঁর রয়েছে  একক ইচ্ছা এবং একক কার্যক্ষমতা।

ছয়শ একত্রিশ খৃষ্টাব্দের শুরুতে ঐক্যমত স্থির হলো এবং এটাই সাম্রাজ্য ও গীর্জার অনুসারীদের রাষ্ট্রীয় ধর্মরূপে স্বীকৃতি লাভ করলো। অন্যসব ধর্মমতের উপর এই নতুন ধর্মমত চাপিয়ে দেয়ার জন্য সম্রাট হিরাক্লিয়াস বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং এ জন্য সর্বউপায় অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু কিবতীরা এটাকে ধর্মবিকৃতি আখ্যা দিয়ে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলো এবং নিজেদের পুরোনো ধর্মবিশ্বাস রক্ষার জন্য প্রাণপণ প্রতিরোধে অবতীর্ণ হয়েছিলো

অবশেষে সম্রাট হিরাক্লিয়াস দ্বিতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেন এবং কিছুটা ছাড় দিয়ে ঘোষনা করলেন, ‘ঈশ্বর’- তাঁর রয়েছে একক ইচ্ছা, এ বিশ্বার গ্রহণ করাই যথেষ্ট। দ্বিতীয় অংশটি, অর্থাৎ ইচ্ছাকে কার্যকর করার ক্ষমতা, তো এ বিষয়টি মূলতবী রেখে এসংক্রান্ত তর্ক-বিতর্কের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন, এমনকি তিনি রাজকীয় ফরমানরূপে প্রাচ্যদেশের সব অঞ্চলে তা প্রেরণ করলেন। কিন্তু তাতেও মিশরের গণঅসন্তোষ প্রশমিত হলো না। মিশরে সাইরাসের দীর্ঘ দশবছরের শাসনকাল ছিলো নিষ্ঠুরতম নিপীড়ন-নির্যাতনের যুগ। তখন এমন সব লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে যা শুনলে এখনো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হতো। ঝুলন্ত মানুষকে আগুনে ঝলসানো হতো এবং চর্বি গলে গলে আগুন নিভে যেতো। কখনো বস্তায় ভবে ‘অপরাধী’কে নিক্ষেপ করা হতো সমুদ্রে। এধরনে অসংখ্য নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার কাহিনীতে ইতিহাস ভরপুর।

১. (a. j. butler: arab’s conqust of egypt and the last thirty years of the roman dominion, p 29-30)
২. প্রাগুক্ত, পৃ: ১৮৩-৮৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: দয়া করে কপি করা থেকে বিরত থাকুন, ধন্যবাদ।