প্রথম যখন নবী করীম (সাঃ) এর নিকট ওহী নাজিল হয়, তখই তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার করতে আদিষ্ট হননি। তখন শুধু তাঁর নিজের সম্পর্কেই বিধি-বিধান অবতীর্ণ হতো।(১)
এরপর কিছুদিন ওহীর ধারা বন্ধ থাকার পর পুনরায় যখন ওহী আসা শুরু হয়, তখন তাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে ইসলাম প্রচার করতে আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তখন দুনিয়া জুড়ে ছিল মূর্খতা ও পথভ্রষ্টতার রাজত্ব, বিশেষ করে আরবের লোকদেরকে তাদের অহংকার, গর্ব এবং পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুসরণ সত্যের ধ্বনিতে কান লাগানোর মোটেই অনুমতি দিত না। তাই মহান আল্লাহ তা’আলার হিকমত ও প্রজ্ঞার দাবি ছিল এই যে, প্রথমেই নবী করীম (সাঃ) কে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হবে না। নয়তো ইসলামের প্রথম অবস্থাতেই মানুষ ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যাবে। তাই হুযুরে আকরাম (সাঃ) প্রথম ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন নিজের একান্ত পরিচিত লোকদেরকে এবং তাদেরকে, যাদের উপর তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল অথবা নিজ দূরদর্শিতার কারণে তিনি যাদের মাঝে মঙ্গল ও কল্যানের নির্দশন দেখতে পেতেন।
এ প্রক্রিয়ায় সর্বপ্রথম তাঁর স্ত্রী হযরত খাদীজা (রা.), হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.), নবী করীম (সাঃ) এর চাচাত ভাই হযরত আলী (রা.) এবং নবীজীর পালক পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারিছা (রা.) ইসলাম কবুল করেন। হযরত আবূ বকর (রা.) নবী করীম (সাঃ) এর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব হতেই তাঁর বন্ধু ছিলেন। তিনি নবীজীর সততা, বিশ্বস্ততা এবং উন্নত চরিত্র সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলেন। তাই রাসূলে আকরাম (সাঃ) যখন তাকে নিজের রাসূল হওয়া সম্পর্কে অবহিত করলেন, সাথে সাথেই হযরত আবূ বকর (রা.) তা বিশ্বাস করে নিলেন এবং কালিমা শাহাদাত পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
হযরত আবূ বকর (রা.) তাঁর গোত্রে সর্বজনমান্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। সকল আচার-আচরণে লোকেরা তাঁর উপর আস্থা রাখত। ইসলাম কবুল করার পর তিনিও সে সকল লোককে ইসলামের দাওয়াত দিতে শরু করেন, যাদের মাঝে তিনি সততা ও কল্যাণের নিদর্শন দেখতে পান। ফলে হযরত উসমান (রা.), হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) এবং হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.), হযরত আবূ বকর (রা.) এর আহ্বানে সাড়া দিলেন। তিনি তাঁদের সবাইকে হুযুরে আকরাম (সাঃ) এর নিকট নিয়ে গেলেন এবং তাঁরা সবাই ইসলাম কবুল করলেন।
তাঁদের পর হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.), হযরত উবায়দা ইবনুল হারিছ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.), হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ আদাভী (রা.), হযরত আবূ সালামা মাখযুমী (রা.), হযরত খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনুল আস (রা.), হযরত উসমান ইবনে মাযউন (রা.) এবং তাঁর দুভাই হযরত কুদামা (রা.) ও হযরত উবায়দুল্লাহ (রা.) এবং হযরত আরকাম ইবনে আরকাম (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা সবাই ছিলেন কুরাইশ বংশের লোক। কুরাইশ বংশের নয় এমন লোকদের মধ্যে হযরত সুহাইব রুমী (রা.), হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.), হযরত আবূ যার গিফারী (রা.) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) সে সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। তখনো পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াতের কাজ অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে চালু ছিল। ইবাদত-বন্দেগি এবং শরিয়তের বিভিন্ন আমল লুকিয়ে লুকিয়ে আদায় করা হতো। এমনকি পিতা পূত্রকে এবং পুত্র পিতাকে লুকিয়ে নামাজ পড়তেন। এভাবে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যখন ত্রিশের বেশি হয়ে গেল, তখন নবী করমি (সাঃ) তাঁদের জন্য একটি প্রশস্ত ঘর নির্ধারণ করে দিলেন; ঘরটিতে তাঁরা সবািই সমবেত হতেন এবং রাসূলে মাকবুল (সাঃ) তাঁদের দ্বীনের কথা শিক্ষা দিতেন।
এভাবে ইসলামের দাওয়াতের কাজ তিন বছর পর্যন্ত চলে। এর ভেতর কুরাইশদের বিপুল সংখ্যক লোক ইসলামে দীক্ষিত হয় এবং আরো অনেকেই মুসলমান হতে শুরু করেন। ফলে এ খবর মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানে স্থানে লোকজনের মধ্যে এ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা হতে থাকে। এভাবেই ক্রমে ক্রমে একদিন প্রকাশ্যে সত্যের প্রতি আহ্বান করার সময় এসে উপস্থিত হয়।