এ বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক একমত যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শুভ জন্ম হয়েছিল সে বছরের রবিউল আওয়াল মাসে, যে বছর \’আসহাবে ফীল\’ (হস্তিমালিক বাহিনী) কা\’বা শরীফের উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালিয়েছিল এবং আল্লাহ তা\’আলা আবাবীল অর্থাৎ কতগুলো নগণ্য ও ক্ষুদ্র পাখির দল পাঠিয়ে তাদের পরাস্ত করেছিলেন। পবিত্র কুরআনেও এ ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। \’আসহাবে ফীলে\’র এ ঘটনাও রাসূলে মাকবুল (সাঃ) এর জন্ম গ্রহণের সাথে সংশ্লিষ্ট বরকতসমূহের সূচনা হিসেবেই ঘটেছিল। নবী করীম (সাঃ) যে ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে হাজ্জাজের ভাই মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের (১) অধিকারে এসেছিল।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, (২) \’আসহাবে ফীলে\’র ঘটনা * ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিল ঘটেছিল। এতে প্রতীয়মান হয় , যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শুভাগমন হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মের পাঁচশত একাত্তর বছর পর হয়েছিল।
হাদীস শাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম ইবনে আসাকির (র.) (৩) পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন \”হযরত আদম (আ.) ও হযরত নূহ (আ.) এর মাঝে এক হাজার দু\’শ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত নূহ (আ.) থেকে হযরত ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত এক হাজার একশ\’ বিয়াল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ.) হতে হযরত মূসা (আ.) পর্যন্ত পাঁচশ\’ পঁয়ষট্টি বছর চলে গেছে। হযরত মূসা (আ.) হতে হযরত দাঊদ (আ.) পর্যন্ত পাঁচশ\’ ঊনসত্তর বছর, হযরত দাঊদ (আ.) হতে ঈসা (আ.) পর্যন্ত এক হাজার তিনশ\’ ছাপ্পান্ন বছর এবং হযরত ঈসা (আ.) থেকে শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পর্যন্ত ছয়শ\’ বছরের ব্যবধান ছিল।
এ হিসাব অনুযায়ী হযরত আদম (আ.) হতে হযরত রাসূলে মাকবুল (সাঃ) পর্যন্ত পাঁচ হাজার বত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে হযরত আদম (আ.) এর বয়স প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী নয়শ\’ ষাট বছর ছিল। তাই হযরত আদম (আ.) দুনিয়াতে আগমনের প্রায় ছয় হাজার বছর অর্থাৎ সপ্তম সহস্রাব্দে খাতামুল আম্বিয়া নবী করীম (সাঃ) এ পৃথিবীতে শুভাগমন করেন।
[তারীখে ইবনে আসাকির, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক হতে- ১ম খনণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯ ও ২০]
মোটকথা, যে বছর \’আসহাবে ফীলে\’র আক্রমণ ঘটেছিল, সে বছরের রবিউল আওয়াল মাসের বারো তারিখ (৪) সোমবার পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য অসাধারণ দিন ছিল। এদিন বিশ্বসৃষ্টির উদ্দেশ্য, দিন-রাতের পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য, হযরত আদম (আ.) ও তাঁর রহস্য, হযরত ইবরাহীম (আ.) এর দোয়া এবং হযরত মূসা (আ.) ও প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ পৃথিবীতে শুভাগমন করেন।
একদিকে পৃথিবীর প্রতিমা-গৃহে নবুয়ত-সূর্যের কিরণ রশ্মি প্রসারিত হচ্ছে, অন্যদিকে পারস্য রাজ্যে কিসরার শাহী মহলে ভুকম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে এবং রাজপ্রাসাদের চৌদ্দটি চূড়া (৫) তাতে ভেঙ্গে ভূপাতিতে হচ্ছে, পারস্যের শ্বেত উপসাগর হঠাৎ করে শুকিয়ে যাচ্ছে এবং পারস্যের অগ্নিশালার সেই অগ্নিকুণ্ড, যা একহাজার বছর ধরে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও নির্বাপিত হয়নি, তা নিজে নিজেই নিভে যাচ্ছে। [সীরাতে মুগলতাই, পৃষ্ঠা-৫]
প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অগ্নিপূজা ও সব ধরনের বিভ্রান্তির পরিসমাপ্তির ঘোষণা এবং পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের পতনের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে বর্ণিত আছে (৬) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্মের সময় তাঁর সম্মানিত মায়ের উদর হতে এমন এক নূর প্রকাশিত হয়েছিল, যার আলোতে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, যখন তিঁনি ভূমিষ্ঠ হন, তখন তিনি দু\’হাতের উপর ভর দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। এরপর তিনি হাতে একমুঠি মাটি তুলে নেন এবং আকামের দিকে চোখ তুলে তাকান। -[মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়্যাহ।]
(১) সীরাতে মোগলতাই, পৃষ্ঠা-৫।
(২) দুরুসুত তারিখ আল ইসলামি, পৃষ্ঠা ১৪।
(৩) এ সম্পর্কে আরো বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। তবে ইবনে আসাকির এ বর্ণনাটিকেই সঠিক বলেছেন। ১; খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।
* ইয়েমেনের বাদশাহ্ আবরাহা তার বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে কা\’বা শরীফ ধ্বংস করতে এসেছিল। এদের \’আসহাবে ফীল\’ বলে।
(৪) এ বিশয়ে সবাই একমত যে, নবী করীম (সাঃ) এর জন্ম রবিউল আওয়াল মাসের সোমবার দিন হয়েছিল। কিন্তু তারিখ নির্ধারণে চারটি রেওয়ায়েত প্রসিদ্ধ রয়েছে। ২রা, ৮ম, ১০শ ও ১২শ, তারখ। তন্মধ্যে হাফিয মুগলতাই (র) ২রা তারিখের রেওয়ায়েতকে গ্রহণ করে অন্য রেওয়ায়েতগুলোকে দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু প্রসিদ্ধ রেওয়ায়েত হচ্ছে ১২শ তারিশের রেওয়ায়েত। হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (র) এ রেওয়ায়েতে সকলে একমত বলে দাবি করেছেন। \’কামিলে ইবনে আছীর\’ গ্রন্থে এ তারিখই গ্রহণ করা হয়েছে।
মাহমুদ পাশা মিশরী গণনার মাধ্যমে ৯ তারিখ গ্রহণ করলেও তা সকলের মতের বিপরীত ও সনদবিহীন উক্তি। যেহেতু চাঁদ উদয়ের স্থান বিভিন্ন, তাই গণনার উপর এতটুকু বিশ্বাস ও নির্ভরতা জন্মায় না যে, তাঁর উপর ভিত্তি করে সকলের বিরোধিকা করা যাবে।
(৫) মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়্যাহ।
(৬) হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (র.) বলেন, হযরত ইবনে হাব্বান ও হাকীম এ বর্ণনাকে সহীহ ও বিশুদ্ধ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।-মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়্যাহ হতে ণাশরুত তীব।