রোমান শাসনে মিশরঃ ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অবস্থা

মিশর ছিলো রোমান সাম্রাজ্যের অধীন খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। নীলনদের কল্যাণে দেশটি ছিলো সুজলা, সুফলা ও উর্বরা। কিন্তু রোমকদের যুগপৎ শাসন-শোষণ ও ধর্মীয় নিপীড়নের ফলে সপ্তম শতকে মিশরই ছিলো আল্লাহর যমীনে সবচেয়ে দূর্ভাগা দেশ। খৃস্টধর্ম মিশরকে কিছুই দিতে পারেনি। দিয়েছে শুধু যিশুর সত্তাগত প্রকৃতি, ইশ্বরতত্ত্ব এবং অতিপ্রাকৃত দর্শনবিষয়ক ব্যাপক কোন্দল ও বিবাদ-বিতর্ক, যা সপ্তম শতকে বীভৎসতম রূপ ধারণ করেছিলো এবং মিশরীয় জাতির চিন্তাশক্তিকে স্থবির এবং কর্মশক্তিকে নিস্তেজ করে দিয়েছিলো। পক্ষান্তরে রোমান শাসন তাদের দিয়েছিলো শুধু ধর্মীয় নিপীড়নের বিভীষিকা এবং রাজনৈতিক শাসন-শোষণ ও দাসত্বের বীভৎসতা। মাত্র দশ বছরে মিশর যে ভয়াবহ ধর্মীয় নিপীড়ন ও রাজনৈতিক শাসন-শোষণের শিকার হয়েছে ইউরোপ ধর্মীয় তদন্তের যুগে কয়েক দশকেও তা ভোগ করেনি। ফলে জীবনের সার্বজনীন সৃজনশীলতা থেকে এবং ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সাধনায় উত্তরণের ক্ষেত্রে মিশর একেবারেই পিছিয়ে পড়েছিলো। রোমান উপনিবেশ হওয়া সত্ত্বেও তার যেমন রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার ছিলো না, তেমনি ছিলো না খৃস্টধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার। ডঃ গ্যাস্টপ লেভন বলেন-

\’বলতেই হবে, মিশরকে খৃস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিলো এবং এর ফলে সে অবক্ষয়ের অতলে চলে গিয়েছিলো, ইসলামের বিজয়াভিযানের আগে যা থেকে সে আর উদ্ধার পায়নি। নানা ধর্মীয় বিবাদ-বিতর্কের বেড়াজালে আটকা পড়ে মিশর হয়ে পড়েছিলো চরম দুর্দশার শিকার। কারণ দল-উপদলগুলো ছিলো ভয়ঙ্কর হানাহানি ও সঙ্ঘাত-সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত। ফলে ধর্মীয় বিভক্তি এবং শোষণ-নিপীড়নে বিপর্যস্ত মিশর রোমকদের প্রতি চরম বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলো এবং রোমান শাসনের থাবা থেকে মুক্তি লাভের প্রহর গুণছিলো।\’১

ডঃ আলফ্রেড জি, বাটলার বলেন- \’সপ্তম শতকে ধর্ম-সমস্যা ছিলো মিশরীয়দের কাছে রাজনৈতিক সমস্যার চেয়ে গুরুতর। কেননা রাজক্ষমতা ও রাজ্যশাসনকে কেন্দ্র করে দল-উপদল ও বিবাদ-কোন্দল সৃষ্টি হয়নি, হয়েছে ধর্মীয় চিন্তাধারা ও মতবিশ্বাসকেই কেন্দ্র করে। আর ধর্মকে মানুষ এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতো না যে, তা পুণ্য-কর্মের সহায়ক, বরং তাদের কাছে ধর্ম ছিলো কিছু মৌলিক বিষয়ের তত্ত্ব-বিশ্বাস।

ফলে যাবতীয় বিরোধ ও তর্ক-বিবাদ ছিলো নানান বিশ্বাসের মধ্যে বিভিন্ন সূক্ষ্ম-জটিল পার্থক্য ও কল্পনাপ্রসূত চিন্তাধারার ভিত্তিতে। এমনকি অর্থহীন ও দুর্বোধ্য বিভিন্ন বিষয় এবং ধর্মের মূল ও অতিপ্রাকৃত দর্শনের চুলচেরা পাথক্যকে উপলক্ষ করে জীবন দিতেও তারা কুষ্ঠিত হতো না।

অন্যদিকে রোমানরা মিশরকে গ্রহণ করেছিলো শুধু দুধের বকরীরূপে। তারা দুধ দোহন করতো শেষ ফোঁটা পর্যন্ত। ঘাস ও দানা-পানি যা খাওয়াতো তা শুধু এজন্য যে ওলানে দুধ যেন ভালো করে জমে। মিশরে তাদের কাজ ছিলো শুধু মিশরীয়দের সম্পদলুণ্ঠন ও রক্তশোষণ। আলফ্রেড জে বাটলারের নীচের মন্তব্য থেকে তা স্পষ্ট-

\’রোমকরা মিশর থেকে মাথাপিছু খাজনা ও বিভিন্নমুখী কর উশুল করে নিতো এবং নিঃসন্দেহে তা ছিলো মানুষের সাধ্যাতীত, আর তা আরোপ করা হতো সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে।\’

হিস্টোরিয়ানস হিস্টোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড-এর লেখকবৃন্দ বলেন-

বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজভাণ্ডারে মিশর তার উৎপাদিত সম্পদের বিরাট অংশ জমা দিতো। মিশরীয় কৃষকশ্রেণী যদিও সর্বপ্রকার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলো তবু তারা কর ও খাজনা দিতে বাধ্য ছিলো। উচ্চহারের ভূমিখাজনা ছাড়াও ছিলো বিভিন্ন কর। ফলে ঐ সময়কালে মিশরের সম্পদ হয়ে পড়েছিলো ক্রমসঙ্কোচনশীল।

এভাবেই মিশর নিষ্পোষিত হচ্ছিলো একাধারে ধর্মীয় নিপীড়ন, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার ও অর্থনৈতিক শোষণের জাঁতাকলে। ফলে জনগণ নিছক বেঁচে থাকার সংগ্রামেই ছিলো ব্যতিব্যস্ত। তাদের জীবনে নেমে এসেছিলো চরম দৃর্দশা এবং তারা হয়ে পড়েছিলো সর্বপ্রকার সুশীল চিন্তা সম্পর্কে উদাসীন।

আবিসিনিয়া:

মিশরের প্রতিবেশী দেশ আবিসিনিয়া, আরবদের কাছে তার পরিচয় ছিলো হাবাশা নামে। হামাশার জনগোষ্ঠীও মানুবাদের অনুসারী ছিলো। তদুপরি তারা অসংখ্য প্রতিমার উপাসনা করতো, একত্ববাদের নামে যা কিছু ছিলো তা প্রতিমাবাদেরই উন্নত রূপ ছাড়া আর কিছু ছিলো না, তবে তার উপর খৃস্টধর্মের তত্ত্ব ও পরিভাষার আবরণ ছিলো। তাদের মধ্যে না ছিলো আধ্যাত্মিক প্রাণ ও প্রেরণা, না ছিলো জাগতিক উচ্চাভিলাষ। বরং নিকা ধর্মসম্মেলনের সিদ্ধান্ত ছিলো, ধর্মীয় বিষয়ে আবিসিনিয়ার নিজস্ব কোন সত্তা নেই, বরং তা হবে রাজসভার সম্পূর্ণ অনুগত।

হাবাশার কর্তব্য ছিলো শুধু রোমানদের সেবার জন্য প্রচুর পরিমাণে কালো ও কর্মঠ দাস সরবরাহ করা। মিশরে যাও কিছু ধর্মীয় উত্তাপ ছিলো, হাবাশায় তাও ছিলো না। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো শোচনীয়, কিন্তু ধর্মীয় অবস্থা ছিলো আরো শোচনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from Islamic History

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading